২৪খবরবিডি: 'সম্প্রতি গেজেট হওয়া ডিটেইলড এরিয়া প্ল্যানের (ড্যাপ) কারণে ব্যাপক ক্ষতির মুখে পড়েছেন স্বল্প প্রশস্ত রাস্তার পাশের জমির মালিক ও আবাসন ব্যবসায়ীরা। পাঁচ কাঠার জমিতে আগে যেখানে ১১০০-১২০০ বর্গফুটের ১৬টি ফ্ল্যাট পাওয়া যেত, এখন সেখানে পাওয়া যাবে আটটি ফ্ল্যাট। আর আয়তন হবে প্রতিটির হাজার বর্গফুটেরও অনেক কম।'
'আগে পাওয়া যেত নয়-দশতলার নকশা। এখন পাওয়া যাবে পাঁচতলা। এতে ফ্ল্যাটের দাম যেমন অনেক বেড়ে যাবে, তেমনি জমির দামও কমে যেতে পারে। এ ছাড়া আরও অনেক সমস্যা তৈরির আশঙ্কা রয়েছে। এ অবস্থায় আদালতের দ্বারস্থ হওয়ার উদ্যোগ নিয়েছে রিয়েল এস্টেট অ্যান্ড হাউজিং অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশ (রিহ্যাব)। শিগগির তারা বিষয়টি নিয়ে আদালতে যাবেন বলে জানা গেছে। আর ক্ষতিগ্রস্ত হওয়ার কারণে নতুন করে কেউ রাজধানী উন্নয়ন কর্তৃপক্ষের (রাজউক) কাছে করছেন না নকশার আবেদন। এ প্রসঙ্গে রাজউক চেয়ারম্যান আনিছুর রহমান মিঞা ২৪খবরবিডিকে বলেন, ড্যাপ গেজেট হওয়ার পর প্রথম দিকে মনে হয়েছিল এই ড্যাপে মানুষ ক্ষতিগ্রস্ত হবেন। কিন্তু বাস্তবতা হলো, ছোট ছোট রাস্তার পাশে এভাবে একের পর এক বহুতল ভবন উঠতে থাকলে এই শহরকে আর শৃঙ্খলার মধ্যে আনা যাবে না। সরু রাস্তা সরুই থাকবে। কোনো দিন প্রশস্ত হবে না। তবে নতুন ড্যাপে অপরিকল্পিত এলাকা যেমন পীরেরবাগ, কাফরুল ও পুরান ঢাকার মতো কিছু এলাকার জমির মালিকরা ক্ষতিগ্রস্ত হবেন। তবে আপাতদৃষ্টিতে ক্ষতিগ্রস্ত হলেও শহরকে বাসযোগ্য রাখতে হলে এর কোনো বিকল্প নেই। দীর্ঘমেয়াদে এর সুফল পাওয়া যাবে।'
'জানা গেছে, নতুন ড্যাপে রাস্তার প্রশস্ততা অনুযায়ী ৯টি ক্যাটাগরিতে ভাগ করা হয়েছে। আর ইমারতের শ্রেণি করা হয়েছে তিনটি। সম্পূর্ণ আবাসিক, আবাসিক কাম বাণিজ্যিক ও সম্পূর্ণ বাণিজ্যিক। এগুলোর প্রতিটির আবার ছয়টি করে ক্যাটাগরি করা হয়েছে। নতুন নিয়মে ব্যবহারযোগ্য ভূমির পরিমাণ ক্ষেত্রবিশেষে অর্ধেকে নামিয়ে দেওয়া হয়েছে। পাশাপাশি ব্যবহারযোগ্য ফ্লোর স্পেসও অনেক কমিয়ে দেওয়া হয়েছে। জমির মালিক ও আবাসন ব্যবসায়ীরা বলছেন, এতে করে রাজধানীতে আবাসন সংকট বাড়বে। বাসা ভাড়া বৃদ্ধি পাবে। সাধারণ মানুষের ক্রয়ক্ষমতার বাইরে চলে যাবে স্বপ্নের ফ্ল্যাট। এসব কারণে অনেক সামাজিক সমস্যাও তৈরি হবে। তাঁরা বলছেন, ড্যাপে ছোট ছোট জমি নিয়ে ব্লক তৈরির কথা বলা হয়েছে। কিন্তু যেখানে দু-তিনজনই ঐকমত্যে আসতে পারে না, প্রতিবেশীর সঙ্গে সদ্ভাব থাকে না, ভাই ভাইয়ে দ্বন্দ্ব থাকে সে রকম অবস্থায় খণ্ড খণ্ড জমি এক করে ব্লক বানানো বড় চ্যালেঞ্জ।'
'আবাসন ব্যবসায়ীদের নেতৃবৃন্দের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, আবাসন ব্যবসায়ীরা সাধারণত ৮ থেকে ১২ ফুট ও ১২ থেকে ১৬ ফুট প্রশস্ত রাস্তার পাশে ভবন তৈরি করে থাকেন। রাস্তার প্রশস্ততা কম থাকলে সামনের জায়গা ছেড়ে রাস্তা প্রশস্ত করে বহুতল ভবন তুলতেন। সে ক্ষেত্রে আগের নিয়েমে পাঁচ কাঠার একটি প্লটে ৪০ শতাংশ জমি ছেড়েও ৯-১০তলা ভবনের নকশা পেতেন। এবার সেই সুযোগ বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে। ফ্লোর এরিয়া রেশিও (এফএআর-ফার) কমিয়ে দেওয়া হয়েছে। রিহ্যাবের সিনিয়র সহসভাপতি কামাল মাহমুদ বলেন, অসংখ্য ভুলে ভরা এই ড্যাপের কারণে আবাসন ব্যবসায়ী ও খণ্ড জমির মালিকরা ব্যাপক ক্ষতিগ্রস্ত হবেন। ড্যাপ প্রণয়নকারীরা যৌক্তিক কারণ ছাড়াই নিজেদের মতো করে বানিয়েছে। নদীনালা-খাল ভরাট করা আবাসন প্রকল্পকে বৈধতা দেওয়া হয়েছে। আমরা অনেকবার তাদের বলেছিলাম রাস্তা প্রশস্ত করার বিধান রেখে যেন ড্যাপ প্রণয়ন করা হয়। এ জন্য আমাদের সঙ্গে প্রয়োজনে আলোচনায় বসেন। কিন্তু তারা মিথ্যা আশ্বাস ও আমাদের ধূম্রজালের মধ্যে রেখে ড্যাপ করেছে। এতে করে জিডিপিতে ১৫ শতাংশ অবদান রাখা ও আবাসনের সঙ্গে সম্পৃক্ত ২৪০টি সহযোগী ব্যবসা প্রতিষ্ঠানও হুমকির মুখে পড়বে। ইতোমধ্যে দেখা গেছে কেউ আর রাজউকে নকশার আবেদন করতে যাচ্ছে না।'
নতুন আবেদনকারী মিলছে না: গত ২৩ আগস্ট ড্যাপ গেজেট হওয়ার পর গত এক মাসে কেউ রাজউকে ভবন নির্মাণের নকশার জন্য আবেদন করেননি। যাঁরাই আবেদন করতে যাচ্ছেন তাঁরা জানতে পারছেন ১০-১২ ফুট প্রশস্ত রাস্তার পাশে আগের মতো নয়-দশতলা ভবনের নকশা মিলবে না। তখনই তাঁরা আবেদন না করে ফিরে যাচ্ছেন। তাঁরা মনে করছেন, এই নিয়ম বেশি দিন থাকবে না। রাজউকের কর্মকর্তা-কর্মচারীরাও তাঁদের এমনই আশ্বাস দিচ্ছেন। তাঁরাই
রাজউকের সংশোধিত ড্যাপে নতুন সংকট
গ্রাহকদের কিছু দিন পর আবেদন করার পরামর্শ দিচ্ছেন। রাজউকের পরিচালক-২ (উন্নয়ন ও নিয়ন্ত্রণ) তানজিলা খানম বলেন, সংশোধিত ড্যাপ গেজেট হওয়ার পর নতুন করে কেউ নকশার আবেদন করেননি। তিনজন মাত্র ভূমি ব্যবহার ছাড়পত্র নিয়েছেন। আগে যেসব আবেদন জমা ছিল ও আগে যাঁরা ভূমি ব্যবহার ছাড়পত্র নিয়েছিলেন, তাঁরাই এখন আবেদন করছেন।'
কেন এই অবস্থা: 'ধরা যাক ১২ থেকে ১৬ ফুট রাস্তার পাশে ৫ কাঠার একটি প্লট। প্রতি কাঠার আয়তন ৭২০ বর্গফুট। পাঁচ কাঠার আয়তন ৩ হাজার ৬০০ বর্গফুট। এ ধরনের রাস্তার পাশে ফার (ফ্লোর এরিয়া রেশিও) ধরা হয়েছে ১ দশমিক ৭৫। এই ৩ হাজার ৬০০ বর্গফুটকে ১ দশমিক ৭৫ দিয়ে গুণ করলে হয় ৬ হাজার ৩০০ বর্গফুট। এটাই হবে ব্যবহারযোগ্য ফ্লোর। ফলে এ ধরনের প্লটে নিচতলায় কার পার্কিং রাখলে বাকি চারটি তলার বেশি উঁচু করার সুযোগ থাকবে না। প্রতিটি তলায় দুটি করে ফ্ল্যাট তৈরি করলে কমন স্পেস ছাড়া প্রতি ফ্ল্যাটের আয়তন হবে ৭৮৭ দশমিক ৫ বর্গফুট। একইভাবে রাস্তার প্রশস্ততা অনুযায়ী ৬ ফুট থেকে ৮ ফুট প্রশস্ত রাস্তার ফার ধরা হয়েছে ১ দশমিক ২৫। একক বা দুই পরিবারের জন্য এ রকম বাড়ি হবে। ৮ থেকে ১২ ফুট প্রশস্ত রাস্তার ফার ধরা হয়েছে ১ দশমিক ৫। ১৬ থেকে ২০ ফুট প্রশস্ত রাস্তার ফার ধরা হয়েছে ২। এ ছাড়া ২০ ফুট রাস্তার ফার ধরা হয়েছে ২ দশমিক ৫, ৩০ ফুট রাস্তার ফার ৩, ৪০ ফুট রাস্তার ৩ দশমিক ৫, ৬০ ফুট রাস্তার ফার ৩ দশমিক ৭৫ ও ৮০ ফুট রাস্তার ফার ৪ দশমিক ২৫। প্লটভেদে এভাবেই নির্ধারিত হবে ব্যবহার যোগ্য ফ্লোর স্পেস।' ফারের এই শর্তের কারণে স্বল্প প্রশস্ত রাস্তার পাশের জমির মালিক ও ছোট জমির মালিকরা বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হবেন। ব্যবহারযোগ্য ফ্লোর পাবেন আগের তুলনায় অনেক কম। আর রাস্তা যত প্রশস্ত হবে, সেখানে ফ্লোর স্পেস বেশি হবে। ভবনের উচ্চতাও বাড়বে। তারপরও আগের চেয়ে ব্যবহারযোগ্য ফ্লোর স্পেস কমবে।'